একনজরে টি আলী স্যার
জাতি গঠনের অন্যতম এক কারিগর পঞ্চখণ্ডের সন্তান তজম্মুল আলী। তিনি ‘টি. আলী স্যার’ নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। আদর্শ শিক্ষকের পথিকৃৎ, তাঁর দীর্ঘ দিন শিক্ষকতার জায়গায়, আদর্শ শিক্ষকের -এর সম্মানার্থে হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের সম্মুখস্থ ক্রস সড়কটি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘টি আলী স্যার’ নাম করণ করা হয়েছে।
জন্ম:
১৯১৩ সালের ৩০ এপ্রিল বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতা ইউনিয়নে কালাইউরা গ্ৰামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তজম্মুল আলী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আনজু মিয়া ও মাতার নাম খতিজা বিবি। তিনি ছিলেন বাবা-মার কনিষ্ঠ সন্তান।
শিক্ষাজীবন :
নিজ গ্রামের পাঠশালায় তজম্মুল আলীর লেখাপড়া শুরু । এরপর তিনি জলঢুপ মধ্যবঙ্গ উচ্চ বিদ্যালয় ও ভারতের শিলচরে অবস্থিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করে নরমাল (পণ্ডিত) ডিগ্রী অর্জন করেন।
কর্মজীবন :
তজম্মুল আলীর কর্মজীবন শুরু হয় মহান পেশা শিক্ষকতা দিয়ে। তিনি ১৯৩৫ সনে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার সুজাউল মাদ্রাসায় সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে বিয়ানীবাজারের মাথিউরা প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকতা করেন। মাথিউরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে পাঁচ বছর সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪২ সালে তিনি বদলি হয়ে ভারতের বদরপুর ভাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে যোগদান করেন। এখানে ২ বছর চাকুরির পর ১৯৪৪ সালে তিনি প্রাথমিক স্তর ছেড়ে করিমগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন।
১৯৪৫ সনে তিনি সহকারি শিক্ষক হিসেবে সুনামগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। একই বছর অজ্ঞাত কারণে তাঁকে শিলং সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে আবার যোগদান করতে হয়। সেখান থেকে বদলী হন হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি এই স্কুলের মুসলিম ছাত্রাবাসের হল সুপারের দায়িত্ব প্রাপ্ত হোন। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে দীর্ঘ ৩১ বছর সুনামে শিক্ষকতা করে ১৯৭৮ সনে তিনি সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
টি. আলী স্যার অবসর পরবর্তী আমৃত্যু ২২ বছর পৈতৃক বাড়িতে জীবনযাপন করেছেন। অসংখ্য গুনী মানুষ গড়ার কারিগর তজম্মুল আলী তার নিজ উপজেলা বিয়ানীবাজারেও অত্যন্ত সাধাসিধে জীবন যাপন করেছেন।
হোস্টেল সুপার:
টি. আলী স্যার অত্যন্ত মেধাবি, ন্যায় পরায়ণ ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজে সময়নিষ্ঠ ছিলেন। বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে তার ছিল মমতাও ভালোবাসার সম্পর্ক। ফলে অল্প সময়ে তিনি হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকদের কাছে আপনজন হয়ে উঠেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন জেদী এবং তেজস্বী প্রকৃতির। শিক্ষক হিসাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। শিক্ষার্থীদের সাথে তার ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ।
হোস্টেল সুপার এর দায়িত্বে সার্বিক নিয়মানুবর্তিতা, সময়জ্ঞান, নৈতিকশিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে ছাত্রদের চর্চার বিষয়ে ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। আলী স্যারকে কথনও বাবার মতো, কখনও শিক্ষাগুরু কখনও বন্ধুর মতো পেয়েছেন বলে মূল্যায়ন করেন তার ছাত্ররা।
দুই পরিবার:
শিক্ষকতার নেশা, হোস্টেল সুপারের দায়িত্ব ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দূরাবস্থায় নিজ বাড়ি বিয়ানীবাজারে খুব কমই আসতে পারতেন। সেই সুবাদে হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়ে উঠে তাঁর হোস্টেল পরিবার।দীর্ঘ ৩১ বছর এই বিদ্যালয়ে একাধিক দায়িত্ব পালন ও অসংখ্য ছাত্রের ভালোবাসায় কাটিয়েছেন তিনি।
টি আলী স্যার বিয়ানীবাজার উপজেলার জলঢুপ ( উত্তর পাড়িয়াবহর) গ্রামে স্ত্রী ফয়জুন নেছা ও তিন সন্তান ফেরদৌসী বেগম মিনা .ফয়েজ আহমদ ছানা, ফয়সল আহমদ রুহেল কে নিয়ে বসবাস করতেন। মেয়ে ফেরদৌসী বেগম মিনা ও বড় ছেলে ফয়েজ আহমদ ছানা বর্তমানে স্থায়ীভাবে আমেরিকাবাসী। ছোট ছেলে ফয়সল আহমদ রুহেল স্থায়ীভাবে যুক্তরাজ্যবাসী।
সম্মান:
আলোকিত এই শিক্ষকের সম্মানে হবিগঞ্জবাসী তাঁর কর্মস্থল হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় সম্মুখস্থ ক্রস সড়কটির নতুন নাম দিয়েছেন ‘টি আলী স্যার সড়ক’। ২০১৯ সালের ১লা নভেম্বর হবিগঞ্জের স্থানীয় সংসদ সদস্য এডভোকেট আবু জাহির এম.পি এ সড়কটি উদ্বোধন করেন]।
তজম্মুল আলী শিক্ষকতায় অতি সাধারণ অবস্থা থেকে মেধা, শ্রম, ধৈর্য, সাহস ও সততায় একজন আদর্শ শিক্ষক হিসাবে নিজেকে গড়েন।
গুনী এই শিক্ষকের টি. আলী স্যার সম্পর্কে তাঁরই ছাত্র হবিগঞ্জের প্রাজ্ঞলোক তোফায়েল আহমদ বলেন, স্যারের গঠন আকৃতি খাঁটো হলেও তিনি মেধা ও মননশীলতায় ছিলেন অতি উচ্চমানের পণ্ডিত, আর পাঠদানে ছিলেন যত্নবান। তাঁর কণ্ঠস্বর ও সাহস ছিল স্মরণযোগ্য। হবিগঞ্জ শহরে হোস্টেল সুপার হিসেবে এতই সমাদৃত ছিলেন যে, শহরে কোথাও ছাত্ররাজনীতির নামে সংঘাতের আবাস পেলে শহরের শান্তিপ্রিয় লোকজন টি. আলী স্যারের সহায়তা নিতেন। ছাত্রাবাস থেকে টি. আলী স্যারকে ঘটনাস্থলে কেউ কেউ নিয়ে আসতেন। স্যারের উপস্থিতি মানে শিষ্যদের মাথা নিচু করে দৌড় প্রতিযোগিতা দেখা। এভাবে অসংখ্য সংঘাত থেকে হবিগঞ্জ শহরের মানুষ রক্ষা পেত।
হবিগঞ্জ সরকারি স্কুলের আরেক ছাত্র দেশের প্রখ্যাত গুণী শিল্পী সুবীর নন্দীর মতে, টি. আলী স্যার ছিলেন একজন দায়িত্বশীল রসিক স্বভাবের লোক। আর স্কুলের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে টি.আলী স্যার স্বল্পভাষী হিসেবে সকলের নিকট সমাদৃত ছিলেন। পাশাপাশি তিনি ছিলেন ভীষণ কাব্যপ্রেমী ও সংগীত প্রেমী। এ রকম শ্রদ্ধা ও সম্মানের মুকুট ক’জনার ভাগ্যে জুটে!
স্বরণ ও স্বীকৃতি:
টি আলী স্যার রোড
হবিগঞ্জ সরকারি স্কুলের শিক্ষক-অভিবাবকদের সিংহভাগ জানতো তজম্মুল আলী ( টি আলী স্যার) হবিগঞ্জের সন্তান। তার মৃতুর সংবাদের পর বলা যায় জেনেছেন তিনি বিয়ানীবাজারের সন্তান। ২০১৯ সালের ১লা নভেম্বর হবিগঞ্জ সরকারি স্কুলের শিক্ষক,প্রাক্তন শিক্ষার্থী-অভিবাবকদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তার স্বরণে হবিগঞ্জ সরকারি স্কুল সম্মুখস্থ শহরের ক্রস রোডের নামকরণ করা হয়েছে- ‘টি. আলী স্যার রোড’।
টি আলী মেমোরিয়াল লাইব্রেরী
টি আলী স্যার এর সন্তানদের উদ্যোগে বিয়ানীবাজার উপজেলার ঐতিহ্যবাহি জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ে “টি. আলী মেমোরিয়াল লাইব্রেরি” প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
টি. আলী স্যার ফাউণ্ডেশন
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কল্যাণ ও সম্মানে কাজ করঅর লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে -টি আলী স্যার ফাণ্ডেশন। যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত ফাউন্ডেশনটি প্রতিবছর টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদক প্রদান করছে।
এছাড়াও অসুস্থ শিক্ষক সহ অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল শিক্ষকদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করছে ফাউন্ডেশন।
স্মরণগীতি
টি আলী স্যার স্যারকে নিয়ে আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা স্মরণগীতিতে শিল্পী রফিকুল আলম সুরারোপ করেছেন এবং মকসুদ জামিল মিন্টু নাট্যজন ঝুনা চৌধুরীর তত্বাবধানে স্যারের উপর একটি ডকুমেন্টারির তৈরী করেছেন।
বই
• তাঁর সম্মানে সাংবাদিক শাবান মাহমুদ সম্পাদিত টি আলী স্যার স্বারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। গুণী এই শিক্ষকের জীবন ও কর্ম নিয়ে লিখেছেন- তার সহকর্মী, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শুভার্থীরা।
• সাংবাদিক কাজী তোফায়েল আহমদ সম্পাদিত ‘শিক্ষাব্রতী মহানপূরুষ টি আলী স্যার’ স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ সালে।
ইন্তেকাল:
এই গুণী শিক্ষক তজম্মুল আলী ২০০০ সালের ২৮ ডিসেম্বর সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার জলঢুপে নিজ বাড়ীতে ইন্তেকাল করেন। ২০০৯ সাল থেকে তাঁর প্রাক্তন ছাত্রদের উদ্যোগে বিভিন্ন মানবিক ও সেবামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে পরিচালিত প্রতি বছর ৩০শে এপ্রিল স্যারের জন্ম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে।